নিজস্ব প্রতিবেদক : জাতীয় মাছ ইলিশ এখন আর সাধারণ মানুষের নাগালে নেই। একসময় যে মাছ ছিলো প্রায় সব শ্রেণির মানুষের পাতে, এখন তা বিলাসপণ্য হয়ে উঠেছে। বাজারে ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া। অথচ এই মাছের উৎপাদনে মানুষের কোনো বিনিয়োগ নেই—পুরোটাই প্রকৃতির দান।
কিন্তু দাম বাড়লেও জেলেদের জীবনে আসে না কোনো পরিবর্তন। নদীতে জীবন ঝুঁকিতে ফেলে মাছ ধরলেও লাভের বড় অংশ চলে যায় ট্রলার মালিক, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের পকেটে।
মূল্য নির্ধারণের নীতিহীনতা
বরিশাল, ভোলা ও চাঁদপুরে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইলিশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে একটি অদৃশ্য সিন্ডিকেট। দাম নির্ধারণে মূল ভূমিকা রাখে ট্রলার মালিক ও আড়তদাররা। পরে এই চক্রে যুক্ত হয় পাইকারি ব্যবসায়ী। জেলেরা মাছ ধরলেও দাম ঠিক করার ক্ষমতা তাদের নেই।
চুক্তি অনুযায়ী জেলেদের পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয়, কিন্তু মাছ বিক্রির লাভের ভাগ যায় মালিকদের কাছে। ট্রলার মালিকরা আড়তদারদের কাছ থেকে আগাম টাকা নেন, ফলে ধরা মাছ বাধ্যতামূলকভাবে নির্দিষ্ট আড়তেই বিক্রি করতে হয়। সেখানে হাতেগোনা কয়েকজন পাইকারি ব্যবসায়ী মিলে বাজারদর ঠিক করেন।
ধাপে ধাপে দাম বৃদ্ধি
ইলিশ ঘাটে উঠার পর প্রতিটি ধাপে বাড়ে দাম। ট্রলার মালিক থেকে আড়তদার, পাইকারি ক্রেতা থেকে খুচরা বিক্রেতা—প্রত্যেক পর্যায়ে প্রতি কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে লাভ যোগ হয়। ঢাকার বাজারে পৌঁছাতে এক কেজি ইলিশের দাম বেড়ে যায় কয়েকশ টাকা।
মাছ কমে যাওয়া ও খরচ বৃদ্ধি
এখন ইলিশ আহরণ অনেক কমে গেছে। অন্যদিকে বেড়েছে ডিজেল, বরফ ও নৌযানের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ। ফলে জেলেদের আয় কমছে। ভোলার এক ট্রলার মালিক জানান, আগে এক ট্রিপে যেখানে ৩০ লাখ টাকার মাছ ধরা পড়ত, এখন চার-পাঁচ লাখ টাকার বেশি আসে না।
জেলেদের ভাগ্যে সামান্য আয়
মাসের পর মাস সমুদ্রে মাছ ধরে জেলেরা হাতে পান কয়েক হাজার টাকা। খারাপ মৌসুমে শূন্য হাতে ফিরতে হয়। পরিবার চালাতে তারা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেন, যা তাদের ঋণের ফাঁদে বন্দি করে রাখে।
চাঁদপুরের জেলে ইসমাইল হোসেন জানান, ভালো দিনে তারা সাত-আট কেজি ছোট ইলিশ ধরেন। খরচ বাদে প্রতিজনের ভাগে থাকে মাত্র ৭০০ থেকে ১,০০০ টাকা।
নিলামে কোটি টাকার লেনদেন
২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর বরিশাল অঞ্চলের ৮১ জন আড়তদার প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি টাকার ইলিশ বিক্রি করছেন। পাইকারি বাজারে এক কেজি বড় ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২,০০০ টাকায়, আর ঢাকায় খুচরায় দাম পৌঁছায় ২,২০০ থেকে ২,৪০০ টাকায়। ছোট ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮৭৫ টাকা কেজি দরে।
মূল্য নিয়ন্ত্রণে কারও নজর নেই
ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণে কোনো সরকারি সংস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। ক্যাবের দাবি, মৎস্য অধিদপ্তর চাইলে প্রকৃত খরচ নির্ধারণ করে দাম স্থির করতে পারে। কিন্তু মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুর রউফ বলেন, তাদের কাজ শুধু টেকসই উৎপাদন ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করা, দাম নির্ধারণ নয়।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম বলেন, “ইলিশের স্বল্পতা ও বাড়তি চাহিদার অজুহাতে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছে। যতদিন মানুষ এই দামে ইলিশ কিনবে, ততদিন কেউ দাম নিয়ন্ত্রণে আগ্রহ দেখাবে না।”
অর্থাৎ, প্রকৃতির দান ইলিশ এখন মানুষের নাগালের বাইরে—কেবল ব্যবসায়ীদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে এর দাম।
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ- মোঃ অনিক। মোবাইলঃ ০১৭১১-৪২৩৫৩২
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ১০৮৯-শিকদার ভবন, পোর্ট রোড ভুমি অফিসের বিপরীতে, বরিশাল -৮২০০।
ই-মেইল: barishalcrimetrace@gmail.com
Copyright © 2025 Barisal Crime Trace । বরিশাল ক্রাইম ট্রেস. All rights reserved.