নিজস্ব প্রতিবেদক : ঝিনাইদহ-২ (সদর ও হরিণাকুণ্ডু) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অনলাইনে প্রচারণায় নেমেছেন নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সহ-সভাপতি নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল।
গতবছর আমি-ডামি সংসদ নির্বাচনে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নির্দেশে তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। গণঅভ্যুত্থানে সংসদ সদস্য পদ হারান তিনি।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা, স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলার বহু অভিযোগ রয়েছে মহুল ও তার ভাই ঝিনাইদহ পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাইয়ুম শাহরিয়ার জাহেদী হিজলের বিরুদ্ধে।
ফ্যাসিস্ট এই দুই আওয়ামী লীগ নেতার অপতৎপরতায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে। এদিকে সাবেক এই ডামি এমপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
স্থানীয়রা জানান, আওয়ামী লীগ নেতা মহুলের এমপি হওয়ার স্বপ্ন দীর্ঘদিনের। ২০০৭ সালের নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আম মার্কায় অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই নির্বাচন না হওয়ায় সে সময় স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায় তার।
সেই স্বপ্ন পূরণের পথ খোলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। বিএনপি-জামায়াতসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করলে আওয়ামী লীগ সব আসনে ডামি প্রার্থী দেয়। নৌকার বিরুদ্ধে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী ঠিক করে দেয় আওয়ামী লীগ। ঝিনাইদহ-২ আসনে আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী হন মহুল। শেখ হাসিনার ইশারায় তাকে বিজয়ী করা হয়।
পেশীশক্তি খাটিয়ে মহুলের ছোটভাই কাইয়ুম শাহরিয়ার জাহেদী হিজল ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র পদ দখলে নেন। নির্বাচিত হওয়ার পর পৌরভবনে বসে মদপান করে আলোচনায় আসেন হিজল। পৌরসভার বেশিরভাগ ঠিকাদারি কাজ করাতেন নিজের লোকদের দিয়ে। এ নিয়ে ঠিকাদারদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
সংসদ নির্বাচনে মহুল স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন— এমন তথ্য প্রচার করে তার ঘনিষ্ঠজনেরাও ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। আসন্ন নির্বাচনে তার অংশগ্রহণকে জুলাই আন্দোলনকারীরা ভালোভাবে নিচ্ছেন না। তারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মহুলের নির্বাচনে অংশগ্রহণকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে আসছেন।
গত ১৩ নভেম্বর ঝিনাইদহ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে মহুলের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ইতোমধ্যে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন মহুলের পক্ষে।
তিনি প্রচার শুরু করেছেন ২০২২ সালের জুন মাসে দল থেকে পদত্যাগ করেন মহুল। আসাদুজ্জামানের দাবি, মূলত মহুল সাহেব নামমাত্র সহ-সভাপতি থাকলেও দলের কার্যক্রমে তিনি কখনো সক্রিয় ছিলেন না।
আওয়ামী লীগের একজন হিসেবে তিনি কখনো বিবেচনায় ছিলেন না। তিনি হয়তো ওই বিবেচনায় পরিচিত হতেও চাননি। এসব কারণেই আগামী নির্বাচনে মহুল নির্বাচনে আসলে জনগণের সাড়া পাবেন বলে বিশ্বাস করেন।
তবে জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ‘এই দাবি সর্বৈব মিথ্যা। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতেন মহুল। গত বছরও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অংশ নেন তিনি। হাসিনার পতনের দিন পর্যন্ত দলীয় ক্যাডারদের অর্থ দিয়ে চাঙা রাখতেন।’
আওয়ামী লীগ নেতা আসাদ কারাগারে থাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর সাথে যোগাযোগ রেখে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
হরিণাকুন্ডু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মশিয়ার রহমান জোয়ারদার, আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল হোসেন, সাজেদুল ইসলাম টানু মল্লিক, সাইফুল ইসলাম টিপু মল্লিক, সাইদুর রহমান, সাবদার রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা ও আজিজুর রহমান সরব হয়েছেন।
মহুলের পক্ষে ভোটের মাঠে তৎপর হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল হাসান ফোটন, যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মামুনুর রশীদ টোকন, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মুঞ্জুর পারভেজ তুষার, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আশফাক মাহমুদ জন, জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শাহরিয়ার করীম রাসেল, সাধারণ সম্পাদক রানা হামিদ, জেলা শ্রমিক লীগের যুগ্ম সম্পাদক নাসির উদ্দীন, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল ইমরান, উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আশরাফুল হক জুয়েল, ঘোড়শাল ইউপি চেয়ারম্যান চিহ্নিত সন্ত্রাসী পারভেজ মাসুদ লিল্টন, আওয়ামী লীগ নেতা ফলসীর বজলুর রহমান, দৌলতপুরের আবুল কালাম আজাদ, রঘুনাথপুরের বশির আহাম্মেদ, কালীচরনপুরের জাহাঙ্গীর হোসেন, মহারাজপুরের খুরশিদ আলম মিয়া, কুমড়াবাড়িয়ার সিরাজুল করিম, পদ্মকরের বিকাশ কুমার, পাগলাকানাইয়ের আবু সাঈদ, কুমড়াবাড়িয়ার সাবেক চেয়ারম্যান শামছুল হক, গান্না ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতিকুল হাসান মাসুম ও সুরাটের সাবেক চেয়ারম্যান কবির হোসেন জোয়ারদার (কেবি)। এ ছাড়া নিষিদ্ধ সংগঠনটির সাথে যুক্ত আরতি দত্ত, তবিবুর রহমান লাবু, মো. ইউনুচ আলী, ইউপি সদস্য ওয়াসিম মণ্ডল, মাহফুজুর রহমান মাহফুজ, বিল্লাল হোসেন, হাসেম আলী ও মলয় কুমার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন।
ঝিনাইদহ জেলা ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিহান হোসেন বলেন, ‘আমরা দেখেছি এই মহুল অর্থ দিয়ে ছাত্রলীগকে বিভিন্নভাবে নির্দেশনা দিয়েছিল আন্দোলন দমাতে।
মহুলের ভাই হিজলের নেতৃত্বে পৌরসভা ভবন থেকে লাঠিসোঁটা বের করে ছাত্র-জনতাকে আঘাত করে রক্ত ঝরানো হয়েছে। পঙ্গু করা হয়েছে। এই মহুল হিজল যদি এই ঝিনাইদহের রাজপথে আসার চেষ্টা করে দাতভাঙা জবাব দেবে ছাত্র-জনতা।’
হুশিয়ারি দিয়ে ঝিনাইদহ শহর শিবিরের সেক্রেটারি পারভেজ মাসুদ বলেন, ‘তারা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের পিঠের চামড়া থাকবে না।’
ইশা ছাত্র আন্দোলন ঝিনাইদহের সভাপতি নাইমুল ইসলাম বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে ঝিনাইদহে যারা আওয়ামী লীগকে পুর্নবাসন করবেন তাদের আস্তানাও এই ঝিনাইদহে রাখা হবে না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা আহবায়ক আবু হুরায়রা বলেন, ‘২০২৪-এর ডামি নির্বাচনে নির্বাচিত এমপি নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ওই পাতানো নির্বাচনে যারা অংশ নিয়েছিল তারা প্রত্যেকেই হাসিনার দোসর। তাদের কাউকে দেশের কোন জায়গা থেকে নির্বাচন অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না।
মহুল সাহেব ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সহ-সভাপতি। তার ভাই হিজল সাহেব পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। আমরা অবাক হই লজ্জিত হই মানুষকে বোকা বানিয়ে কিভাবে তারা এখনো নির্বাচনের চেষ্টা করে। তারা যদি এই দুঃসাহস দেখায় তাহলে তাদের অবস্থা খুবই ভয়ানক হবে।’
ঝিনাইদহ জেলা শিবিরের সভাপতি আরিফ হুসাইন বলেন, ‘আওয়ামী দুঃশাসনের সময়ের এমপিরা যারা সুবিধা ভোগ করেছে তাদেরকে এই ঝিনাইদহে নামতে দেওয়া হবে না। ছাত্র-জনতা তাদেরকে প্রতিহত করবে।’
গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, ‘এই ঝিনাইদহে নাকি গুঞ্জন রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতারা আগামী নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে অংশ নিবে। আমি স্পষ্টভাবে বলি, আওয়ামী লীগের কোনো নেতা আগামীতে ডামি–মামি–স্বতন্ত্র কোনো নামে ঝিনাইদহে ইলেকশন করতে পারবে না।
সারা বাংলাদেশের কোথাও আওয়ামী লীগ ডামি–মামি–স্বতন্ত্র কোনো নামে অংশ নিতে পারবে না। বিচারের আগে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না।’
এলাকাবাসী জানান, গত বছরের ১৬ জুলাই ঝিনাইদহে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়। শহরের উজির আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে এই হামলায় অনেকে আহত হন। তৎকালীন সংসদ সদস্য নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুলের নির্দেশে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সজিব হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আল ইমরান হামলায় নেতৃত্ব দেন।
২০২৩ সালের ১৩ জুলাই পাগলাকানাই ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক লিটন মন্ডলকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন করে দেয় মহুলের পালিত সন্ত্রাসীরা। এছাড়া একটি হাত ও পা কেটে ঝুলন্ত অবস্থায় ফেলে পালিয়ে যায় তারা। পাগলাকানাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান চিহ্নিত অস্ত্রধারী আবু সাইদ বিশ্বাস ও রাজন কসাইয়ের নেতৃত্বে যারা হত্যার উদ্দেশে আক্রমণ করে তারা সবাই মহুলের অনুসারী।
চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি ভুয়া ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’র কাগজপত্র তৈরি করে এক নারীর ২৩ শতক জমি বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগে মহুলের বিরুদ্ধে যশোর আদালতে মামলা হয়। মামলার বাদী যশোর শহরের কাজীপাড়া এলাকার আজিজ সিটির বাসিন্দা শেখ আবদুস সবুরের মেয়ে ফারজানা ইকবাল।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মহুল। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি নোভারটিস বাংলাদেশ লিমিটেডের ২৩০ কোটি টাকার প্রায় ১০ লাখ শেয়ার রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের কাছে হস্তান্তরে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভোট গণতান্ত্রিক অধিকার রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ছাড়া সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, জনগণ যাকে বেছে নিবেন তিনিই নির্বাচিত হবেন। আমি অনেক আগেই আওয়ামী লীগ ছেড়েছি। ২০২২ সালে যখন আমার ভাই স্বতন্ত্র মেয়র নির্বাচন করে তখন আওয়ামী যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের ছেলেরা আমার বাড়িতে হামলা করে ভাংচুর করে এবং প্রচার প্রচারণায় বাধা দেয়।
তাছাড়া প্রচারণার সময় আমার দুই ভাইসহ আমার ভায়ের কর্মী অনুসারীদের ওপরে আক্রমণ করে মারাত্মক ভাবে জখম করে। তারপর আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে নিজেকে ইস্তফা দিয়। পরে ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বহু হামলা মামলার মধ্যে জনগণের ভালবাসায় ভোটে জয়লাভ করি। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ এই সরকারের কাম্য তাই আশাকরি নির্বাচন অংশগ্রহণ মূলক এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হবে।’
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ- মোঃ অনিক। মোবাইলঃ ০১৭১১-৪২৩৫৩২
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ১০৮৯-শিকদার ভবন, পোর্ট রোড ভুমি অফিসের বিপরীতে, বরিশাল -৮২০০।
ই-মেইল: barishalcrimetrace@gmail.com
Copyright © 2025 Barisal Crime Trace । বরিশাল ক্রাইম ট্রেস. All rights reserved.