স্টাফ রিপোর্টার, আগৈলঝাড়া : পুতুল নাচের প্রসঙ্গ এলে অনেকেরই হয়তো মনে পড়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ কিংবা একই শিরোনামে শামসুর রাহমানের কবিতাটির কথা। একটা সময় ছিল যখন গ্রামগঞ্জের হাটবাজার কিংবা খোলা মাঠে মঞ্চ বানিয়ে পুতুল নাচের জমজমাট আসর বসত। তুমুল আগ্রহ নিয়ে তা উপভোগ করত সব বয়সী মানুষ। এখন আর সে আয়োজন চোখে পড়ে না।
দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের অন্যতম এই বিনোদন মাধ্যম। এ পেশার সঙ্গে জড়িত মানুষগুলো অর্থকষ্টে দিনযাপন করছেন। অনেকে পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন।
জানা গেছে, পুতুল নাচের আড়ালে অশ্নীল নৃত্যের বিষয়ে স্থানীয়দের অভিযোগের কারণে ২০১০ সাল থেকে প্রশাসন পুতুল নাচের আসরের অনুমতি দেয় না। এতে বিপাকে পড়েছেন আগৈলঝাড়ার পেশাদার পুতুল নাচ দলের মালিক ও শিল্পীরা।
বরিশালের আগৈলঝাড়ায় ছিল অন্তত পাঁচটি পুতুল নাচের দল- দি তিশা পুতুল নাচ, দি গ্রাম-বাংলা পুতুল নাচ, দি থ্রি-স্টার অপেরা, মনফুল পুতুল নাচ ও দি আল্পনা পুতুল নাচ। এসব দলের বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে।
স্থানীয় আলম গাজী, উপেন হালদারসহ স্থানীয়রা জানান, এক সময় পুতুল নাচের আসরগুলোতে রংবেরঙের বাহারি পুতুল সাজিয়ে তার সঙ্গে সুতা বেঁধে হাতের কারুকাজের পাশাপাশি বাদ্য, গান, নাচ ও অভিনয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হতো। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘এক ফুল দুই মালি’, ‘কাশেম মালার প্রেম’, ‘বেহুলা সুন্দরী’, ‘নৌকাবাইচ’, ‘সাগরভাসা’সহ বিভিন্ন পালা। এই পালা দেখতে ১০ থেকে ২০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ভিড় করত দর্শনার্থীরা।
আগৈলঝাড়ার দি তিশা পুতুল নাচের দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন মানিক বিশ্বাস, পপি ভাবুক ও সজল বালা। তাঁরা কেউ পুতুল নাচাতেন, কেউবা কণ্ঠ দিতেন। এই শিল্পীরা জানান, এক সময় পুতুল নাচের আসর নিয়ে তাঁরা ব্যস্ত সময় পার করতেন। কিন্তু ১০ থেকে ১২ বছর ধরে আসর না হওয়ায় তাঁদের আয়-রোজগার নেই। তাই পেশা বদল করে এখন দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন তাঁরা।
শিল্পীরা জানান, একেকটি দলে ২০-২৫ জন লোক কাজ করতেন। প্রতি রাতে তিনটি করে প্রদর্শনী হতো। এতে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ২৫ হাজার টাকা লাভ হতো। উপজেলার কদমবাড়ি মেলায় এক রাতে সর্বাধিক আড়াই লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছিল। প্যান্ডেলের নিচে কয়েক হাজার দর্শক বসার ব্যবস্থা থাকত। দি গ্রাম-বাংলা পুতুল নাচ দলের সাবেক ম্যানেজার জয়ন্ত বিশ্বাস জানান, পুতুল নাচের দলের মালিকরা কেউ পুতুল কিনে এনে কেউবা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুতুলসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি ভাড়া করে এনে দল চালাতেন।
‘দি তিশা পুতুল নাচে’র মালিক ননী সরকার জানান, আগে প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনী করে বেশ ভালো আয় হতো। তাঁর দলে শিল্পীসহ ২৫ জন লোক ছিলেন। প্রত্যেককে প্রতিদিন ৫০০, ৭০০, ১০০০ টাকা করে বেতন দিতেন। তবে কিছু অসাধু লোকজন এই পুতুল নাচের নামে অশ্নীল নৃত্য দেখানোয় তা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এখন আর কেউ আসরের জন্য তাদের ডাকে না। যে কারণে ঘরে থেকে নষ্ট হচ্ছে প্রায় ৫ লাখ টাকার সরঞ্জামসহ বিভিন্ন ধরনের পুতুল। ২০১১ সালে তাঁর দলের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তিনি বরিশাল ডিসি অফিসে গেলে লাইসেন্স নবায়ন হবে না বলে তাঁকে জানানো হয়।
তিনি আরও জানান, অনুমতি না পেয়ে বন্ধ হওয়ায় অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। কেউ কেউ মারাও গেছেন। ঐতিহ্যবাহী এই বিনোদন মাধ্যমটির পুনর্জাগরণে এটি প্রদর্শনের অনুমতির জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।
এ ব্যাপারে আগৈলঝাড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত জানান, পুতুল নাচের মধ্য দিয়ে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলা হতো। পুতুলগুলো দলের সদস্যদের হাতের সঙ্গে সুতোয় বেঁধে আড়ালে থেকে নাচানো হতো। সঠিকভাবে শুধু পুতুল নাচ দেখালে এখনও মানুষ সপরিবারে এটি উপভোগ করতে যেত। তাই একে টিকিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
এ ব্যপারে ‘আগৈলঝাড়া গিন থিয়েটার’ এবং ‘ব্যান্ড মাতৃভূমি’র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক স্বপন দাস বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পুতুল নাচ বন্ধ থাকায় নতুন প্রজন্মের কাছে এর পরিচিত হ্রাস পেয়েছে। সরকারের উচিত সঠিক তদারকির পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুতুল নাচ প্রদর্শনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে এর প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা।
আগৈলঝাড়ার ইউএনও সাখাওয়াত হোসেন জানান, পুতুল নাচ প্রদর্শনের অনুমতির বিষয়টি তাঁর ভালো জানা নেই। লাইসেন্স নবায়নের জন্য তাঁর কাছে কেউ এলে তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে বলবেন বলে জানান।
Map plugins by Md Saiful Islam | Android zone | Acutreatment | Lineman Training
আপনার মতামত লিখুন :