ভোলায় ঘুষ না দেওয়ায় ৭১ শিক্ষকদের ভাতা বন্ধ এক বছর


Barisal Crime Trace -FF প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩, ১:৩৪ অপরাহ্ণ /
ভোলায় ঘুষ না দেওয়ায় ৭১ শিক্ষকদের ভাতা বন্ধ এক বছর

ভোলা প্রতিনিধি : ভোলায় ঘুষ না পেয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম (৭ম পর্যায়) প্রকল্পে কর্মরত ৭১ জন শিক্ষককে বাদ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভোলা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক উপপরিচালক মো. হুমায়ুন কবির ওই শিক্ষকদের কাছে ঘুষ না পেয়ে তাঁদের বাদ দেন বলে অভিযোগ করেছেন বাড় পড়া শিক্ষকেরা। শুধু তা–ই নয়, হুমায়ুন কবির পরে টাকার বিনিময়ে এই পদগুলোতে নতুন লোকজনকে নিয়োগও দিয়েছেন।

বাড় পড়া শিক্ষকেরা হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে এ ঘটনায় লিখিত অভিযোগ দিলে প্রকল্প পরিচালক গত বছরের এপ্রিলে জেলা প্রশাসককে তদন্ত করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেন। সেই তদন্তের কাজ এখনো শেষ হয়নি। এ কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে বাদ পড়া ও নতুন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের সবারই ভাতা বন্ধ রয়েছে।

বাদ পড়া শিক্ষকেরা জানান, তাঁরা অন্যায়ভাবে বাদ পড়ার পর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। প্রকল্প পরিচালক গত বছর ১০ এপ্রিল চিঠি দিয়ে সাত দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসক তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেন। জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার শাখার তৎকালীন উপপরিচালক (ডিডিএলজি) রাজীব আহমেদ ১৩ জুন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। কিন্তু ওই তদন্ত সরেজমিন অনুসন্ধান না করেই মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে বলে বাদ শিক্ষকেরা অভিযোগ করেন। শিক্ষকদের এই আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্প কর্মকর্তা জেলা প্রশাসককে আবার সাত কার্যদিবসের মধ্যে পুনরায় তদন্তের জন্য চিঠি দেন। গত বছরের ১ আগস্ট সেই সময়সীমা শেষ হয়। তবে অজ্ঞাত কারণে গত সাত মাসেও জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি পুনরায় তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠাননি। এদিকে তদন্ত জটিলতার কারণে নতুন নিয়োগ পাওয়া ও বাদ দেওয়া শিক্ষকদের কেউই এক বছর ধরে ভাতা পাচ্ছেন না। তাঁরা জানান, মসজিদে ইমামতি, মুয়াজ্জিনগিরি, কিংবা ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি মসজিদভিত্তিক পাঠাগারে পড়াতেন তাঁরা। অধিকাংশেরই সংসার চলত এই সামান্য আয়ে। এই প্রকল্পের তাঁরা কোনো বেতন পান না, ভাতা পান। আগের শিক্ষকদের ভাতা ছিল মাত্র দুই শ টাকা। এখন সেটি বেড়ে পাঁচ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই ভাতা বন্ধ থাকায় তাঁরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ভোলা জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক ই-লাহী চৌধুরী কেবল বলেন, তদন্ত চলমান আছে। বর্তমান ডিডিএলজি তদন্ত করছেন। তদন্ত কর্মকর্তা জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার শাখার বর্তমান উপপরিচালক বিবেক সরকার বলেন, তদন্ত চলমান আছে। তদন্তের স্বার্থে উপপরিচালককে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হলেও তিনি নির্ধারিত তারিখে অনুপস্থিত ছিলেন।

বাদ পড়া শিক্ষকেরা অভিযোগ করেন, হুমায়ুন কবির ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর দায়িত্ব গ্রহণের পর কোভিড চলাকালীন প্রকল্পে কর্মরত শিক্ষকদের বাদ দিয়ে গত বছরের জানুয়ারি নতুন ৭১ জনকে চাকরি দেন। কিন্তু শিক্ষকদের বাদ দেওয়ার আগে তাঁদের কারণ দর্শানোর জন্য কোনো চিঠি বা বাদ দেওয়ার কারণ জানানো হয়নি। এখন শুনছেন, উপপরিচালক হুমায়ুন কবির তদন্তে প্রভাব ফেলছেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক মো. হুমায়ুন কবির বর্তমানে পিরোজপুর জেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দায়িত্বে আছেন। মুঠোফোনে যোগযোগ করলে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, যেসব শিক্ষককে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন। অনেকে অন্য পেশায় চাকরি করছেন। অনেকের সনদ জাল। অনেকে দিনের পর দিন প্রকল্পের ও সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করে আসছেন। জাতীয় দিবসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করছেন না। এসব কারণে তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে। নিয়ম অনুসারে নতুনদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখানে কারও কাছে কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে বাদ পড়া শিক্ষকেরা মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন।

ভোলার দৌলতখান উপজেলার মেদুরা ইউনিয়নের মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের শিক্ষক ইমাম মো. শেখ ফরিদ বলেন, তিনি ১৯৯৩ সালে ৪০০ টাকা ভাতা নিয়ে মসজিদভিত্তিক পাঠাগারে পড়ানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ৩০ বছরে অনেক ছেলেমেয়েকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। কোরআন শেখানো ছাড়াও শিশুদের মৌলিক জ্ঞান, দেশপ্রেম, দেশের সরকার, জাতির পিতা সম্পর্কে জ্ঞানদান করেছেন। মসজিদে ইমামতি ও পাঠাগার পরিচালনা করে কোনো রকমে সংসার পরিচালনা করেছেন। উপপরিচালক হুমায়ুন কবির এসে তাঁকে বাদ দিয়েছেন। এখন তিনি কষ্টে আছেন। সন্তানদের তিনবেলা খাবার দিতে পারছেন না।

একই উপজেলার মো. মোসলেউদ্দিন নামের আরেকজন বাদ পড়া শিক্ষক বলেন, তিনি ২০১১ সালে মসজিদভিত্তিক পাঠাগারে পড়ানোর দায়িত্ব পান। উপপরিচালক হুমায়ুন কবির এসে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের দিয়ে শিক্ষকদের কাছে ৫০ হাজার টাকা করে দাবি করেন। সেই টাকা না দিতে পারায় অনেকের মতো তাঁকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। যাঁরা টাকা দিতে পেরেছেন, তাঁদের নতুন করে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি জেলা প্রশাসক, তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সব ধরনের প্রমাণ দেখিয়েছেন।

হাফেজ মো. ইব্রাহীম, মো. নুরুদ্দিন, আবদুর রহমান কাজীসহ একাধিক বাদ পড়া শিক্ষক বলেন, তাঁরা রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠান পালন করে আসছেন, নিয়মিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতেন। তবুও তাঁদের টাকার জন্য বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন তদন্তের নামে তাঁদের সঙ্গে তামাশা করা হচ্ছে।