স্বরূপকাঠিতে কমে গেছে জাহাজ নির্মাণ, বেকার অসংখ্য শ্রমিক


Barisal Crime Trace -FF প্রকাশের সময় : মার্চ ১৬, ২০২৩, ৪:১২ অপরাহ্ণ /
স্বরূপকাঠিতে কমে গেছে জাহাজ নির্মাণ, বেকার অসংখ্য শ্রমিক

স্বরূপকাঠি প্রতিনিধি : পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি (নেছারাবাদ) এলাকাটি জেলার প্রধানতম শিল্পসমৃদ্ধ এলাকা। এ উপজেলার হাজার হাজার লোক জাহাজ নির্মাণশিল্প, ছোবড়া শিল্প, কাঠ শিল্প, নার্সারি, কামার শিল্প, মৃৎ শিল্প, ক্রিকেট ব্যাট শিল্পের সাথে জড়িত। শুধু এলাকার মানুষজনই নন, এসব শিল্পকে কেন্দ্র করে উপজেলার বাইরের খুলনা, রাজবাড়ী ও মাদারীপুরসহ বিভিন্ন এলাকারও বহু লোকের এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

পিরোজপুর জেলাটি নদীমাতৃক অঞ্চল। বাহন হিসেবে এককালে এসব অঞ্চলে কাঠের তৈরি নৌকা ও ট্রলারের প্রচলন থাকলেও এখন স্টিলের তৈরি লঞ্চ, ট্রলার ও কার্গোর প্রচলন বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তাই এসব নৌযান তৈরির লক্ষে উপজেলার স্বরূপকাঠি সদর, সোহাগদল, সুটিয়াকাঠি, তারাবুনিয়া, নাওয়ারা,কালীবাড়ী, বরছাকাঠি, ডুবিরহাট ও বালিহারিতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় শতাধিক ডকইয়ার্ড গড়ে উঠেছে।

জানা গেছে, নানা প্রতিকূলতা স্বত্ত্বেও সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা এসব ডকইয়ার্ডে বিভিন্ন পেশায় প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কর্মরত আছেন। এদের প্রত্যেকের দৈনিক মজুরি ৩৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৯০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও ওভার টাইম নিয়েও কাজ করেন অনেক শ্রমিক। তারা সন্তোষজনক হারে মজুরি পেয়ে থাকেন।

বিভিন্ন সূত্র জানায়, বর্তমানে নৌযান নির্মানের প্লেট, ঝালাইকাঠি ও রং-সহ নানা ধরনের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় নৌযান তৈরির ব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুণ। আর এ কারণেই ডক ইয়ার্ডগুলোতে নৌযান মেরামতের কাজ কিছুটা আগের মতো চললেও নতুন নৌযান নির্মাণ কমে গেছে। শুধু পণ্যের মুল্য বৃদ্ধির কারণেই নয়, পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের সড়কপথে পণ্য পরিবহন বেড়ে গেছে। এ কারণে ট্রাকের কাঠামোসহ পরিবহনের নৌযান তৈরি কমে গেছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। ফলে এই এলাকার ডকইয়ার্ড শিল্পের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

এ ব্যাপারে শ্রমিক মো. নজরুল ইসলাম জানান, আগে এখানকার ডক ইয়ার্ডগুলোতে এত পরিমাণ নৌযান তৈরি হত যে শ্রমিকদের দিনে কাজ করার পরও রাতে ওভারটাইম করতে হতো। ইদানিং জাহাজ নির্মাণ কমে যাওয়ায় শ্রমিকের চাহিদা কমে গেছে। বেতনও আগের তুলনায় কম। বেকারও হয়ে পড়েছেন কেউ কেউ।

হাওলাদার ডকইয়ার্ডের কন্ট্রাক্টর মো. জাহাঙ্গীর হাওলাদার বলেন, জাহাজ তৈরির জন্য যে প্লেটসহ অন্য কাঁচামাল ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোর দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ইদানিং জাহাজ নির্মাণ বা সংস্কারে মালিকদের আগ্রহ কমে গেছে। পূর্বের ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকার প্রতি টন প্লেট এখন এক লাখ ১০ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। শুধু ডকইয়ার্ডেই নয়, এ শিল্পকে কেন্দ্র করে উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ, হার্ডওয়্যার, রং ও যন্ত্রপাতির দোকান গড়ে উঠেছে। সেখানেও বহু শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

ফরাজি এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী মো. মাসুম ফরাজি জানান, আগে প্রতিমাসে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার রং বেচা-কেনা হতো। বর্তমানে মূল্য বৃদ্ধির কারণে জাহাজ নির্মাণ কমে যাওয়ায় প্রতিমাসে ২০ থেকে ২২ লাখ টাকার বেচা-কেনা হচ্ছে। প্রথমে ছোট ছোট নৌযান তৈরি ও মেরামত করা হলেও বর্তমানে বড় বড় নৌযানও তৈরি হচ্ছে ডকইয়ার্ডগুলোতে। এমনকি বর্তমানে এখান থেকে তৈরিকৃত কার্গো ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী কয়েকটি এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে।

উপজেলা সদরের মেসার্স ছালেহীয়া ডক ইয়ার্ডে বর্তমানে মেসার্স পাতারহাট শিপিং লাইনস্-এর এম ভি দোয়েল পাখি ১০ নামক লঞ্চটি নির্মাণাধীন আছে। লঞ্চটির দৈর্ঘ্য ১৯৫ ফুট এবং প্রস্থ ৪২ ফুট। ওই ডক ইয়ার্ডের পরিচালক মো. নূর এ কাওসার বাবু জানান, আগে ডকে জাহাজ নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য জায়গা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। আর এখন নির্মাণ কমে যাওয়ায় বহু জায়গা খালি পড়ে থাকে। কাজ না থাকায় শ্রমিকদের বেকার বসিয়ে রাখতে হচ্ছে।

অগ্রগতি ডক ইয়ার্ড শিপ বিল্ডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী মো. সেলিম হাসান জানান, তার ঢাকার কেরানীগঞ্জে ও স্বরূপকাঠির নাওয়ারায় দুটি ডকইয়ার্ড রয়েছে। ডক দুটিতে প্রায় ৩০০ জন লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। চট্টগ্রামের এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা স্ক্র্যাপ, প্লেট, অ্যাঙ্গেল ও ঝালাই কাঠির কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এগুলোর দাম বৃদ্ধি করায় বর্তমানে জাহাজ নির্মাণ ও সংস্কার কমে আসছে। ফলে বর্তমানে আর্থিকভাবে তারা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এ ব্যাপারে নেছারাবাদ ইউএনও মো. মাহবুব উল্লাহ মজুমদার জানান, স্থানীয় পর্যায়ে কিছু ব্যবসায়ীরা নিজেদের উদ্যোগে এই ব্যবসা চালু রেখেছেন। এর ফলে এখানে বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সরকার এই সম্ভাবনাকে বিবেচনা করে কিভাবে এর পরিসর আরো বাড়ানো যায় সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জাহাজ নির্মাণের এ শিল্পের প্রসারতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যেক্তারা আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসলে এ শিল্প হতে পারে কোটি কোটি টাকা আয়ের উৎস। পাশাপাশি হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর এর মাধ্যমে খুলে যেতে পারে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন দ্বার।