অনলাইন ডেস্ক// গত জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, এক দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয়, তাতে তিনি জয়ী হতে যাচ্ছেন। তিনি বড় বড় বাণিজ্য অংশীদারদের নিজের ইচ্ছার কাছে নত হতে বাধ্য করছেন। প্রায় সব ধরনের আমদানির ওপর দ্বিগুণ অঙ্কের শুল্ক চাপিয়ে দিয়েছেন। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের কোষাগারে প্রতি মাসে কয়েক বিলিয়ন ডলার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ জমা করছেন।
তবে তার পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য অংশীদাররা বিনিয়োগ ও পণ্য কেনার প্রতিশ্রুতি কতটা রাখবে, এই শুল্ক মূল্যস্ফীতি বাড়াবে কি না কিংবা চাহিদা ও প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত ও আদালত এসব হঠাৎ আরোপিত শুল্ককে বৈধতা দেবে কি না; এমন বেশ কিছু বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা এখনও রয়ে গেছে।
হোয়াইট হাউসে অভিষেকের দিনে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর শুল্ক হার ছিল প্রায় আড়াই শতাংশ। বিভিন্ন অনুমান অনুযায়ী, বর্তমানে তা বেড়ে ১৭ থেকে ১৯ শতাংশের মাঝে দাঁড়িয়েছে। আটলান্টিক পরিষদ বলছে, বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হওয়া অতিরিক্ত শুল্কের কারণে এই হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছাবে; যা গত এক শতাব্দিতে সর্বোচ্চ।
বাণিজ্য অংশীদাররা এখন পর্যন্ত পাল্টা শুল্কারোপ থেকে বিরত রয়েছেন। যার ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি আরও গুরুতর পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে রক্ষা পেয়েছে। মঙ্গলবার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ১৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং চীনের সঙ্গে এই ঘাটতি গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে পৌঁছেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি স্থিতিশীলতা দেখিয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক কিছু তথ্য বলছে, শুল্ক ইতোমধ্যে চাকরি, প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। আটলান্টিক পরিষদের অর্থনৈতিক গবেষণা বিভাগের প্রধান জোশ লিপস্কি বলেছেন, ‘‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জয়ী হওয়ার মানে কী?’’ তিনি বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প পুরো বিশ্বে শুল্ক বাড়াচ্ছেন এবং অপ্রত্যাশিতভাবে সহজেই পাল্টা বাণিজ্য যুদ্ধ এড়াতে পারছেন। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে এর প্রভাব কী?
যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের অর্থনৈতিক নীতির প্রধান মাইকেল স্ট্রেইন বলেন, ট্রাম্পের ভূ-রাজনৈতিক বিজয় অসার প্রমাণিত হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘‘ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ট্রাম্প অন্য দেশগুলো থেকে ব্যাপক ছাড় নিলেও অর্থনৈতিকভাবে তিনি বাণিজ্য যুদ্ধে জয়ী হচ্ছেন না। আমরা যা দেখছি, তা হলো—অন্যান্য দেশ তাদের নাগরিকদের ওপর যতটা চাপ সৃষ্টি করতে ইচ্ছুক, তারচেয়ে তিনি (ট্রাম্প) আমেরিকানদের অর্থনৈতিক ক্ষতি করতে বেশি ইচ্ছুক। আমি এটাকে পরাজয় হিসেবেই দেখছি।’’
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে হোয়াইট হাউসের বাণিজ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা ও বর্তমানে আইনি সংস্থা অ্যাকিন গাম্প স্ট্রস হায়ার অ্যান্ড ফেলডের অংশীদার কেলি অ্যান শ বলেন, শক্তিশালী অর্থনীতি এবং রেকর্ড-উচ্চ শেয়ারবাজারের মূল্য আরও আক্রমণাত্মক শুল্কনীতিকে সহায়তা করছে। তবে ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধি, কর হ্রাস, নিয়ন্ত্রণ শিথিল ও জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধির সব নীতি বাস্তবায়নে সময় লাগবে।
তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি, ইতিহাসই এসব নীতির বিচার করবে। তবে আমার জীবদ্দশায় তিনিই প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন।’’
• এখন পর্যন্ত কী কী চুক্তি করেছেন ট্রাম্প?
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাপান, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে আটটি কাঠামোগত চুক্তি সম্পন্ন করেছেন ট্রাম্প। চুক্তির আওতায় এসব অংশীদারদের পণ্যের ওপর ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছেন তিনি।
যদিও তা এপ্রিল মাসে মার্কিন প্রশাসনের ঘোষিত ‘‘৯০ দিনে ৯০টি চুক্তি’’ করার টার্গেটের তুলনায় অনেক কম। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ শতাংশ বাণিজ্য প্রবাহ এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত। চীনা পণ্যের ওপর ৩০ শতাংশ শুল্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। আগামী ১২ আগস্টের মাঝে অতিরিক্ত শুল্ক থেকে ছাড় পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বেইজিংয়ের। চীনকে এই তালিকায় যোগ করলে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের হার বেড়ে প্রায় ৫৪ শতাংশে পৌঁছাবে।
চুক্তি বাদ দিলেও ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের অনেক পদক্ষেপই ছিল উদ্বেগজনক।
বুধবার ভারতের ওপর চাপ আরও বাড়িয়েছেন তিনি। রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানি করায় ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করেছেন। ট্রাম্প ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র জইর বলসোনারোর বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা চলছে অভিযোগ করেছেন। যে কারণে ব্রাজিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আসা পণ্যের ক্ষেত্রেও একই হার প্রয়োগ করতে পারেন তিনি।
অতীতে সুইজারল্যান্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট। সুইজারল্যান্ডের নেতার সঙ্গে ট্রাম্পের একটি চুক্তির আলোচনা ভেস্তে যাওয়ায় দেশটি বর্তমানে ৩৯ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হয়েছে।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের প্রশাসন ও বাইডেনের সরকারের সাবেক বাণিজ্যবিষয়ক আইনজীবীর দায়িত্ব পালন করা রায়ান মাজেরাস রয়টার্সকে বলেছেন, এখন পর্যন্ত যা ঘোষণা করা হয়েছে তা দীর্ঘস্থায়ী, রাজনৈতিকভাবে বাণিজ্য সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। এসব সমস্যা কয়েক দশক ধরেই মার্কিন নীতিনির্ধারকরা দেখে আসছেন এবং সমাধানে পৌঁছানোর জন্য কয়েক বছর না লাগলেও কয়েক মাস সময়ের দরকার হতে পারে।
তিনি বলেন, জাপানের ৫৫০ বিলিয়ন ডলার ও ইইউর ৬০০ বিলিয়ন ডলারসহ ঘোষিত বড় অঙ্কের বৃহৎ বিনিয়োগের জন্য নির্দিষ্ট প্রয়োগ ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে ওয়াশিংটনের।
• প্রতিশ্রুতি ও ঝুঁকি
গত মাসে স্কটল্যান্ড সফরের সময় ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন ১৫ শতাংশ শুল্কে রাজি হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। এই শুল্কের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইউরোপ তেমন কিছুই আদায় করতে না পারায় সমালোচনার মুখে পড়েন উরসুলা।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন এই চুক্তি ইউরোপের মদ প্রস্তুতকারক ও কৃষকদের হতাশ করে। তারা শূন্য শুল্কের বিনিময়ে শূন্য শুল্ক চেয়েছিলেন। ফ্রান্সের জাতীয় দুগ্ধ খাতের সংগঠন এফএনআইএলের প্রধান ফ্রাঁসোয়া-জাভিয়ের হুয়ার্ড বলেন, ৩০ শতাংশ শুল্কের হুমকির চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশ ভালো। তবে তারপরও দুগ্ধ চাষীদের লাখ লাখ ইউরো ক্ষতি হবে বলে জানান তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, ভন ডার লিয়েনের সিদ্ধান্ত ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক এড়াতে সহায়তা করেছে। এছাড়া ট্রাম্পের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনের পাশাপাশি সেমিকন্ডাক্টর, ওষুধ ও গাড়ির ওপর অতিরিক্ত শুল্কের সম্ভাবনাও হ্রাস করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন কৌশলগত পণ্য কেনা এবং ৬০০ বিলিয়নের বেশি ডলারের বিনিয়োগ করার কথা ইইউর প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্র ও কোম্পানির ওপর নির্ভর করছে। এই বিনিয়োগ ব্রাসেলস থেকে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
তবে ট্রাম্প যদি মনে করেন ইইউ, জাপান বা অন্য কেউ তাদের প্রতিশ্রুতি রাখছে না, তাহলে তিনি আবারও অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করতে পারেন বলে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। যদিও এ ধরনের প্রতিশ্রুতি কতটা কার্যকরভাবে নজরদারি করা সম্ভব, তা পরিষ্কার নয়।
এক্ষত্রে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সতর্কতামূলক বার্তা পাওয়া যেতে পারে। ট্রাম্পের প্রথম ধাপের মার্কিন-চীন বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ছোট ছোট ক্রয় চুক্তিগুলোও কখনই পূরণ করেনি চীন। পরবর্তীতে বাইডেন প্রশাসনের জন্য এটিকে জবাবদিহি করা কঠিন হয়ে পড়ে।
কেলি অ্যান শ বলেন, ‘‘সবকিছু এখনও পরীক্ষিত নয়। ইইউ, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে এখন এসবের জন্য কার্যকর করার উপায় বের করতে হবে। এটি কেবল সরকারি কেনাকাটা নয়, বরং বেসরকারি খাতকেও উৎসাহ দিতে হবে যেন তারা যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করে, ঋণ দেয়, কিংবা নির্দিষ্ট পণ্য কেনে।’’
আর সবশেষে ট্রাম্প যেসব শুল্ক একতরফাভাবে আরোপ করেছেন, সেগুলোর আইনি ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তার আইনজীবীরা একটি আপিল আদালতে শুনানিতে কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়েছেন।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৭৭ সালের যে আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে শুল্ক আরোপ করেছেন, সেটার আইনগত বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এই আইনটি সাধারণত শত্রুদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এই বিষয়ে আদালতের রায় যে কোনও সময় আসতে পারে। তবে যেভাবেই হোক, শেষ পর্যন্ত এটি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াবে বলেই মনে হচ্ছে।
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ- মোঃ অনিক। মোবাইলঃ ০১৭১১-৪২৩৫৩২
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ১০৮৯-শিকদার ভবন, পোর্ট রোড ভুমি অফিসের বিপরীতে, বরিশাল -৮২০০।
ই-মেইল: barishalcrimetrace@gmail.com
Copyright © 2025 Barisal Crime Trace । বরিশাল ক্রাইম ট্রেস. All rights reserved.