সঞ্জিব দাস, গলাচিপা// এক বছর হয়ে গেছে। তবুও থামেনি কান্না, থামেনি বুকফাটা হাহাকার। এখনও বাবাকে খোঁজে ছোট্ট মেয়ে ফারিস্তা। দেড় বছর বয়সী শিশুটি হয়তো বুঝতেও পারেনি—তার বাবা আর কখনও ফিরে আসবে না।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, শুক্রবার বিকেল ৩টা। ঢাকার মিরপুর-১০ গোলচত্বরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে নিহত হন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার মো. আতিকুল ইসলাম রুবেল (৩৫)। আন্দোলনের মধ্যে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে একটি গুলি এসে লাগে তাঁর মাথায়। পথচারীরা দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিলেও শেষরক্ষা হয়নি। চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরদিন শনিবার রুবেলের লাশ গলাচিপায় নিয়ে আসা হয়। পরে গলাচিপা জৈনপুরী খানকায় প্রথম এবং তার গ্রামের বাড়ি পানপট্টির গ্রামার্দন এলাকায় দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। আজ তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিবারের পক্ষ থেকে দোয়া-মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে।
রুবেল ছিল একটি পরিবারের ভরসা
আতিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৯১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। ডাক নাম রুবেল। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি ইউনিয়নের গ্রামার্দন গ্রামের শাহ আলম হাওলাদারের চার ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট রুবেল। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী।
২০০৭ সালে গলাচিপা সরকারি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি, ২০১১ সালে বরিশাল সরকারি টেক্সটাইল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা এবং ২০১৪ সালে ঢাকা সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি সম্পন্ন করেন।
রাজধানীর বারিধারায় জাস্টেক্স বায়িং হাউজে সর্বশেষ সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কাজ করতেন তিনি। চাকরি করে উপার্জিত টাকা দিয়ে গলাচিপা পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড রূপনগরে গড়েছিলেন স্বপ্নের ঠিকানা। কিন্তু সেই বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারেননি রুবেল।
২০১৭ সালে বিয়ে হয় রাঙ্গাবালীর মেয়ে মোসা. তামান্নার সঙ্গে। তাদের ঘর আলো করে আসে একমাত্র সন্তান আলিসবা ইসলাম ফারিস্তা। কন্যার বয়স যখন ১৮ মাস, সেই মুহূর্তেই গুলিতে শহীদ হন বাবা।
রুবেল ছিলেন পরিবারের আশ্রয়, ভাইদের ভরসা। চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী ছিলেন তিনি। তাঁর আয়েই চলত পুরো পরিবার, এমনকি বাকপ্রতিবন্ধী ভাইকেও দেখভাল করতেন।
জানা যায়, রুবেলের বাবা শাহ আলম হাওলাদার তখন ৫০০ টাকা বেতনে রেজিস্ট্রি স্কুলে চাকরি করতেন। অল্প বেতনে ছয় সদস্যের সংসার চালানো ছিল কঠিন। ছেলে রুবেল মেধাবী হওয়ায় তার বড় বোন খাইরুন নাহার লিপি তাকে গলাচিপা এনে লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন। তার কাছ থেকেই এসএসসি শেষ করে রুবেল। পাশে ছিল লিপির ভাই শামীমও।
পরিবারের চার ভাইয়ের মধ্যে রুবেল ছিলেন সবচেয়ে স্বাবলম্বী। তাঁর আয়েই চলত পরিবার। ভাই-বোনদের পরিবারও তাঁর থেকে উপকৃত হতো। শহীদ রুবেলের পরিবার, স্ত্রী ও সন্তানের জীবিকা নির্বাহের আর কোনো উৎস নেই।
রুবেলের মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে বাবারও মৃত্যু — দ্বিগুণ শোক ফারিস্তাদের ঘরে
রুবেলের মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই পরিবার হারিয়েছে আরও একজন—রুবেলের বাবা শাহ আলম মাস্টারকে। তিনি গত ২৭ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ছেলের শোকে যেন মাটিই হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি উত্তর পূর্ব পানপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।
স্ত্রীর অশ্রুসিক্ত স্মৃতিচারণ
রুবেলের স্ত্রী তামান্না স্মরণ করেন সেই ভয়াবহ দিনের কথা—
“দুপুর ১২টায় রুবেল ফোন দিয়ে বলেছিল গণ্ডগোল হচ্ছে, বাইরে যেও না। ওটাই ছিল ওর সঙ্গে আমার শেষ কথা। ৩টা ৫২ মিনিটে খবর পাই, গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলাম, কিন্তু তখন সব শেষ।
আমার স্বামী কোনো রাজনীতি করত না। তাহলে সে মরল কেন? তার দায় কে নেবে?
তার ছোট একটা মেয়ে আছে। তাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে গেলাম আমরা।
এখন মেয়েটাকে দেখলেই বুক ফেটে যায়। কে ওর বাবার অভাব পূরণ করবে?”
মায়ের কণ্ঠে হাহাকার
রুবেলের মা মমতাজ বেগম বলেন, “আমার ছেলেটা খুব ভালো ছিল। সারাদিন কাজ করত। সমাজের কথা ভাবত। রাজনীতি করত না। এখন আমাদের দেখবে কে?”
চাচী তাহমিনা বেগম বলেন, “সে আমাদের সবাইকে সাহায্য করত। খুবই ভালো ছেলে ছিল। তার স্ত্রী ও মেয়েটির ভবিষ্যতের জন্য সরকারের সাহায্য দরকার।"
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ- মোঃ অনিক। মোবাইলঃ ০১৭১১-৪২৩৫৩২
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ১০৮৯-শিকদার ভবন, পোর্ট রোড ভুমি অফিসের বিপরীতে, বরিশাল -৮২০০।
ই-মেইল: barishalcrimetrace@gmail.com
Copyright © 2025 Barisal Crime Trace । বরিশাল ক্রাইম ট্রেস. All rights reserved.