নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: জীবনের সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা তখনই সামনে আসে, যখন একজন বাবা নিজের অঙ্গ বিক্রির কথা ভাবেন শুধু সন্তানের প্রাণ বাঁচানোর জন্য। এমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে মনিরুজ্জামান লিটনের জীবনে।
পেশায় তিনি একজন শিক্ষক। সারা জীবন জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন শত শত শিক্ষার্থীর মাঝে। কিন্তু আজ নিজেই ডুবে যাচ্ছেন এক অসহায় লড়াইয়ে ছেলের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে।নীলফামারী সদর উপজেলার চড়চড়াবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মনিরুজ্জামান লিটনের বড় ছেলে রাফিউজ্জামান রাসিক পড়াশোনা করছে পঞ্চম শ্রেণিতে। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল, একদিন ছেলে বড় হয়ে বাবার মতো মানুষের সেবায় কাজ করবে।
কিন্তু সেই আশা এখনো অধরা। রাসিক এপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া (এক ধরনের ক্যান্সার) রোগে আক্রান্ত। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চলছে তার চিকিৎসা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করাতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন প্রায় ২৫ থেকে ২৬ লাখ টাকা। বিপুল এই অর্থ একজন স্কুলশিক্ষকের পক্ষে জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব।
২০২০ সালেই রাসিকের শরীরে এপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া ধরা পড়ে। তখন থেকেই চিকিৎসা চালাতে চালাতে নিঃস্ব হয়ে গেছেন লিটন। বর্তমানে ছেলের চিকিৎসা ব্যয় দৈনিক প্রায় দুই হাজার টাকা, অর্থাৎ মাসে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী, এমনকি প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে এবং নিজের সহায়-সম্পদ বিক্রি করে এতদিন ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বা এ রোগের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার জন্য শেষ পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক হৃদয়বিদারক পোস্ট দেন তিনি ‘আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য আমি আমার কিডনি বিক্রি করতে চাই। দয়া করে কেউ সাহায্য করুন।’ এই কয়েকটি লাইনের মধ্যেই যেন এক বাবার বুকফাটা আহাজারি, সমাজের প্রতি নিঃশব্দ আর্তনাদ ফুটে ওঠে।
পোস্টটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই মন্তব্য করেন, একজন বাবার ভালোবাসা কতটা গভীর হলে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন! কেউ সামান্য সাহায্যের হাত বাড়ান, কেউ বা শুধু সহানুভূতি প্রকাশ করেন। কিন্তু লিটনের মুখে তখন একটাই কথা, আমার ছেলে বাঁচুক, আমি না থাকলেও সমস্যা নেই।
ভেজা চোখে মনিরুজ্জামান লিটন জানান তার সংগ্রামের কথা। তিনি বলেন, আমি ২০২০ সাল থেকে আমার ছেলের জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছি। আমি শুধু আমার ছেলেটাকে বাঁচাতে চাই, আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।
আমার যতটুকু সম্পদ ছিল, সব বিক্রি করে চিকিৎসা করেছি। এখন শুধু আমার বাড়িটাই আছে। সকলের কাছে অনুরোধ, আমার ছেলেকে বাঁচান। নতুবা আমার একটি কিডনি কেউ কিনে নিক, আমি আমার ছেলেকে বাঁচাতে চাই।
ছেলের পাশেই বসে ছিলেন মনিরুজ্জামান লিটনের স্ত্রী রিপা বেগম। তিনি বলেন, আমরা সবাই শুধু আমাদের ছেলেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করছি। আমার স্বামী কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উনি (স্বামী লিটন) বলেছেন, আমি না থাকলে তুমি ছেলেদের দেখে রেখো।
লিটনের মা ও রাসিকের দাদি মেরিনা বেগম বলেন, আমি আমার নাতিকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতাম। করোনার (Covid-19) সময় ওর একদিন জ্বর আসে। তখন তো কেউ ঘর থেকে বের হতে দিত না, তারপরও আমার ছেলে ওকে রংপুরে নিয়ে যায়।
১০ দিন পর রিপোর্টে জানা যায়, নাতির ক্যান্সার হয়েছে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত চিকিৎসা করেই যাচ্ছি। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, আল্লাহ যদি হায়াত দেন, তাহলে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। সবকিছু এখন আল্লাহর হাতে।
স্থানীয় বাসিন্দা আফজাল হোসেন বলেন, আমরা জানি লিটন মাস্টার তার ছেলের চিকিৎসার জন্য সবকিছু শেষ করে ফেলেছেন। শুনেছি, এখন তিনি কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একজন বাবা সবসময় চায় তার সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে। হয়তো লিটন তার সন্তানের জন্য শেষ চেষ্টা করতে চায়।
রাফিউজ্জামান রাসিক বলেন, আমার বাবা আমার পেছনে সব কিছু শেষ করে দিয়েছেন। আমি সুস্থ হয়ে ডাক্তার হব। আমার মত অবহেলিত মানুষদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিতে চাই, যারা অর্থের অভাবে চিকিৎসা নিতে পারে না। আমি জানি কষ্টটা কেমন। যখন আমার সমস্যা বেশি হয়, শরীরে দাগ পড়ে, শরীর এত দুর্বল লাগে যে বই পড়তেও পারি না, হাঁটতেও পারি না।
স্থানীয় ইউপি সদস্য রশিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকার সকলেই জানে মনিরুজ্জামান লিটন অনেকদিন ধরে ছেলের চিকিৎসার জন্য সব কিছু শেষ করে দিয়েছেন। এখন কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে শুনেছি। সন্তানের জন্য বাবার এমন ত্যাগ খুবই বিরল।
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ- মোঃ অনিক। মোবাইলঃ ০১৭১১-৪২৩৫৩২
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ১০৮৯-শিকদার ভবন, পোর্ট রোড ভুমি অফিসের বিপরীতে, বরিশাল -৮২০০।
ই-মেইল: barishalcrimetrace@gmail.com
Copyright © 2025 Barisal Crime Trace । বরিশাল ক্রাইম ট্রেস. All rights reserved.