
নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রচলিত রয়েছে- ধান, সুপারি, ইলিশের গোলা, এ তিনে মিলে ভোলা। অর্থকরী ফসল হিসেবে দ্বীপজেলা ভোলায় সুপারির আবাদ হচ্ছে প্রাচীনকাল থেকেই। স্বাদ ও মান ভালো হওয়ায় দেশজুড়ে চাহিদাও রয়েছে বেশ। অনুকূল আবহাওয়ায় এ বছর জেলাজুড়ে সুপারির ভালো ফলন হওয়ায় প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বাণিজ্যের আশা করছে কৃষি বিভাগ।
সুপারি চাষি ও সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই চার মাসকে বলা হয় সুপারির মৌসুম। এ সময় জেলার প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক সুপারি গাছের মাথায় ঝুলে থাকে কাঁচা-পাঁকা সুপারি।
উৎপাদন খরচ কম এবং অন্যান্য ফসলের চেয়ে লোকসানের ঝুঁকিও কম। এবার প্রতি হেক্টরে পাকা সাড়ে ৬ থেকে ৮ টন সুপারির ফলন হয়েছে। শুকনোর পর যা দাঁড়ায় হেক্টর প্রতি ৫ মেট্রিক টন এবং প্রতিটি গাছ ফলন দেয় টানা ২০-৩০ বছর।
ভোলা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) তথ্য মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৩ হাজার ৫০০ হাজার হেক্টর জমিতে সুপারি উৎপাদন হয়েছে ৬৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। চলতি অর্থবছরে একই পরিমাণ জমিতে উৎপাদন হয়েছে ৮১ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা এবং গাছের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৪২ লাখ।
সরেজমিনে দেখা যায়, এখানকার গ্রাম অঞ্চলের প্রতিটি বসতবাড়ির আঙিনা ও পতিত জমিতে রয়েছে ক্ষুদ্র মাঝারি ও বৃহৎ সুপারি বাগান। প্রতিটি গাছে ১ থেকে ৪টি করে ছড়া (পির) ঝুলে রয়েছে কাঁচা, হলুদ ও কিছুটা লালচে রঙের পাঁকা সুপারি।
পাঁকা সুপারি গাছিদের মাধ্যমে গাছ থেকে নামিয়ে তা যত্নসহকারে বাড়িতে নিচ্ছেন চাষিরা,প্রতিটি ঘরে ঘরে যেন বইছে উৎসবের আমেজ। প্রতি ছড়ায় সর্বনিম্ন ৫০-৬০ পিস থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪৫০-৫৫০ পিস পর্যন্ত সুপারি রয়েছে। স্থান ও আকারভেদে ৩২০ এবং ৪০০ পিস সুপারিকে গণনার ক্ষেত্রে ধরা হয় ১ভি। স্থানীয় বাজারে যার প্রতি-ভি ৪৫০-৬০০ টাকা। এখানকার সুপারি পর্যায়ক্রমে ৩ ভাগে বিক্রি করা হয়- পাঁকা, শুকনো ও ভেজা।
সুপারি চাষি মো. জসিম, মোহাম্মদ আলী, নোমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বংশ পরম্পরায় আমরা সুপারি চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত। একই বাগানে প্রথমে দাদা চাষ করতেন, তারপর বাবা এবং বর্তমানে আমরা করছি। নতুন বাগান করার ক্ষেত্রে চারা কিনতে হয় না, উৎপাদিত সুপারি থেকেই নিজেরা চারা উৎপাদন করি।
তাছাড়া চারা ক্রয়ের প্রয়োজন হলে দামও সহনশীল, ৩০-৪০ টাকায় প্রতিটি ছড়া পাওয়া যায়। অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছর গাছে ভালো সুপারি ধরেছে। এ সিজনে ইতোমধ্যে ২ বার সুপারি পেড়েছি, দামও ভালো পাচ্ছি। গাছে এখনও দুইভাগের একভাগ সুপারি গাছে রয়েছে।
বাবুল, জাহাঙ্গীর, আবুল কাসেম ও খলিল বলেন, কৃষিই আমাদের মূল পেশা। অন্যান্য ফসলের চেয়ে সুপারি বেশি লাভজনক। যেখানে ধান বা সবজি বছরে প্রতি শতাংশে থেকে দেড়-দুই হাজার টাকার বেশি ফসল পাওয়া যায় না সেখানে বছরে ৫-৬ হাজার টাকার সুপারি পাওয়া। উৎপাদন খরচ ও ঝুঁকি কম। তাছাড়া একবার সুপারি চারা রোপণের ৬-৮ বছর পর থেকেই সুপারি গাছ ফলন দেওয়া শুরু করে। যা চলে ২০-৩০ বছর পর্যন্ত।
জহির, লোকমান রফিক ও আনোয়ার অভিযোগ করে বলেন, প্রতি বছর সুপারি আমাদের অন্যতম আয়ের উৎস। যুগ যুগ ধরে আমরা নিজস্ব জমিতে এ চাষের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কখনও কোনো সহযোগিতা ও পরামর্শ পাইনি। খোঁজ ও নেন না তারা। বিভিন্ন সময়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হই, যেমন কোনো বছর ন্যায্য দাম পাই না, আবার কোনো বছর গাছে সুপারি কম ধরে এবং ঝরে পড়ে। এসব বিষয়ে কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও সহযোগিতা পেলে আমাদের উপকার হতো।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপপরিচালক মো. খায়রুল ইসলাম মল্লিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুপারির জন্য দেশের অন্যতম জেলা ভোলা। এ বছর স্মরণকালের সেরা ফলন হওয়ায় আশা করছি ২৩০০ কোটি টাকা বিক্রি হবে, এখনও সব সুপারি কর্তন হয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুপারি যদিও সরাসরি আমাদের তালিকাভুক্ত কৃষিপণ্য না। তবুও যারা বাণিজ্যিকভাবে চাষের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে আমরা ট্রেনিং দিচ্ছি। আগামীতেও দেব, তবে এক্ষেত্রে আমাদের বাজেট নেই। কোনো কৃষকের পরামর্শের প্রয়োজন হলে আমিসহ আমাদের প্রত্যেক উপজেলা কৃষি অফিসার তাদেরকে সহযোগিতা করবেন। সুপারির ভালো ফলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আগামীতে কৃষকদের কারিগরি সহযোগিতা করা হবে।
এদিকে দ্বীপজেলার অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে প্রতি কৃষি বিভাগের যথাযথ সুদৃষ্টির আহ্বান সুপারি চাষী ও সংশ্লিষ্টদের। এতে আরও সমৃদ্ধ হবে এ জেলার কৃষি এবং গ্রামীণ অর্থনীতি।