
অনলাইন ডেস্ক : পিরোজপুরের নাজিরপুরে বন্দোবস্তের নামে অল্প অল্প করে সরকারি অকৃষি জমি বা চান্দিনা ভিটা নেওয়া হয়েছিল দোকানঘর নির্মাণের জন্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই চান্দিনা ভিটায় এখন রীতিমতো পাকা দ্বিতল ভবন। বরাদ্দ ছিল মাত্র অর্ধশতক করে, দখল বেড়ে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ শতাংশে।
জেলা প্রশাসনের দলিল ঘেঁটে জানা যায়, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের পরিবারের সদস্যদের নামই সেখানে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে।
সরকারি জমিতে সাবেক এই মন্ত্রীর ভাইদের ভবনের বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি জেলা প্রশাসন।
পিরোজপুর সদর, নাজিরপুর ও ইন্দুরকানী নিয়ে গঠিত পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাড. শ ম রেজাউল করিমের বাড়ি নাজিরপুরের মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের তারাবুনিয়া গ্রামে। স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী ‘করিম পরিবার’ এলাকায় পরিচিত নাম। বড় ভাই এস এম নূরে আলম সিদ্দিকী শাহীন ছিলেন নাজিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান, আরেক ভাই এস এম নজরুল ইসলাম বাবুল উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি।
মন্ত্রীর এক ভাইয়ের স্ত্রী ইয়াসমিন বেগমও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম এ আউয়ালও একই স্থানে ছয়জনের নামে চান্দিনা ভিটার জমি নিয়ে ভবন তুলেছিলেন। এ নিয়ে কালের কণ্ঠে সংবাদ প্রকাশের পর আউয়াল বাদী হয়ে কালের কণ্ঠের ব্যুরো প্রধান রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। পরে রেজাউল করিম মন্ত্রী হওয়ার পর জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সেই ভবন অবৈধ দেখিয়ে অধিগ্রহণ করে নেয় সরকার।
বর্তমানে ভবনটি নাজিরপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর সরকারি কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু রেজাউল করিম পরিবারের ভবনগুলো টিকে গেছে আগের মতোই।
দোকানঘরের নামে শুরু, গড়াল দ্বিতল ভবনে জেলা প্রশাসকের কাছে চান্দিনা ভিটা হিসেবে দোকানঘর নির্মাণের আবেদন করেন রেজাউল করিমের দুই ভাই ও ভাবি। তাদের প্রত্যেকের নামে আধাশতক করে ডিসিআর (ডিসপোজাল সার্টিফিকেট অব রাইট) বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর একই পরিবারের পক্ষ থেকে আরো ৯ জনের নামে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারি জমি বন্দোবস্ত নেওয়া হয়।
ফলে ১২ জনের নামে বরাদ্দ ছিল প্রায় ছয় শতাংশ। কিন্তু তাদের দখলে গেছে অন্তত ২০ শতাংশ সরকারি জায়গা।
সেই জমিতে এখন আধাপাকা ও পাকা ভবন। নিয়ম অনুযায়ী ডিসিআর জমিতে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ হলেও এই পরিবার বছর বছর তা নবায়ন করেছে নির্বিঘ্নে। স্থানীয় প্রশাসন থেকেও কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত হয়ে রেজাউল করিম প্রথমে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী, পরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী হন। ক্ষমতায় আসার পর তাঁর দুই ভাই সরকারি জমির ওপরই নির্মাণ করেন পূর্ণাঙ্গ দোতলা ভবন। সরকারি বিধি অনুযায়ী এটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও তাতে আপত্তি জানায়নি কেউ।
কারা কিভাবে সরকারি জমি পেলেন পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার সেই ছোট্ট বাজারঘেঁষা সরকারি জমির টুকরোগুলো এখন ইতিহাসের সাক্ষী। নামমাত্র ডিসিআর নিয়ে ২০০৯-১০ অর্থবছরে যাঁরা দোকানঘর তোলার অনুমতি পেয়েছিলেন, তাঁদের নামে এখন স্থায়ী ভবন। সাবেক মন্ত্রীর দুই ভাই নিজেদের নামে, আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনদের নামে জমি বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন জেলা প্রশাসনের দলিল ঘেঁটে এমন চিত্রই মিলেছে।
প্রভাবশালী পরিবারের মধ্যে অন্যতম এস এম নজরুল ইসলাম, পিতা আব্দুল খালেক শেখ। তাঁর পরিচয় আরো বড়। তিনি সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের ভাই। ডিসিআর নম্বর ২৯২(এন), অর্থবছর ২০০৯-১০। নবায়ন হয়েছিল ২০১২ সালের ১৩ মে। তাঁর দোকানঘরটি এখন দোতলা ভবন।
একই পরিবারের আরেকজন এস এম নূরে আলম সিদ্দিক শাহীন, ডিসিআর নম্বর ২৯৩(এন)। নবায়নের তারিখ ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি। তিনিও সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করেছেন।
এ ছাড়া একই অর্থবছরে বন্দোবস্ত পাওয়া অন্যদের মধ্যে রয়েছেন নির্জন কান্তি বিশ্বাস, মো. ডালিম মোল্লা, মো. আবু হাসান, মনোতোষ গাইন, আদম আলী, চঞ্চল কান্তি বিশ্বাস, সিদ্দিকুর রহমান তুহিন। তাঁদের নামেও ডিসিআর রয়েছে বলে কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছে নাজিরপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস।
অফিস সূত্র জানায়, উল্লেখিত ব্যক্তিরা কখনও বাস্তবে দোকানঘরের কাছেও যাননি। কারণ তাঁরা জানতেন না তাঁদের নাম ব্যবহার করে জমি বন্দোবস্ত নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের নামে থাকা ডিসিআর বাতিল করুক প্রশাসন। আমরা সরকারি জমির কাছে যাব না।
এক ডিসিআর বাতিল, এলো মন্ত্রীর ভাবির নাম সবচেয়ে আলোচিত নাম ইয়াসমিন বেগম যিনি সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের এক ভাইয়ের স্ত্রী। প্রথমে ওই ডিসিআরটি ছিল স্থানীয় বাসিন্দা হান্নান খান মন্টোর নামে। পরে তাঁর ডিসিআর বাতিল করে একই জায়গা নতুনভাবে বন্দোবস্ত দেওয়া হয় ইয়াসমিন বেগমের নামে। দলিল অনুযায়ী, ডিসিআর নম্বর ২৯১(এন), অর্থবছর ২০০৯ু১০; সবশেষ নবায়ন ২০১৪ সালের ৩ ডিসেম্বর।
এভাবে ১২ জনের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল প্রায় ছয় শতাংশ সরকারি জমি। কিন্তু মাঠে মাপ দিতে গেলে দেখা যায়, তাঁদের দখলে এখন ২০ শতাংশেরও বেশি জায়গা। নিয়ম অনুযায়ী চান্দিনা ভিটার জমিতে পাকা স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ হলেও ওই এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে দোতলা ভবন, দোকান আর টিনের ঘর। সবই সরকারি জমির ওপর।
যা বলছেন তারা এস এম নূরে আলম সিদ্দিক শাহীন মুঠোফোনে বলেন, ‘আমরা দুই ভাই পৃথকভাবে সরকারি জমি বন্দোবস্ত নিয়ে দ্বিতল ভবন করেছি। শুধু আমরাই নয়, অনেকেই এই কাজট করেছেন। সাবেক এমপি আউয়াল একইভাবে ভুয়া ব্যক্তির নামে জমি বন্দোবস্ত নিয়ে ভবন করেছিলেন। সেটি এখন প্রশাসন ব্যবহার করছে।’ বন্দোবস্তের শর্ত ভঙ্গের কথা স্বীকার করে এস এম নূরে আলম সিদ্দিক শাহীন বলেন, ‘জেলা প্রশাসন আমাদের কোনো নোটিশ দেয়নি, বন্দোবস্তও বাতিল করেনি।
নাজিরপুরের সহকারী কমিশনার (ভুমি) শপথ বৈরাগী মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি গত ১৬ অক্টোবর দায়িত্ব নিয়েছি। ডিসিআরের জমিতে পাকা ভবন করার বিধান নেই। সেই আইন ভঙ্গ করে ইতোপূর্বে একটি দ্বিতল ভবন হয়েছিল। ছয়জনের নামে থাকা সেই ডিসিআর বাতিল করে ভবনটি সরকার অধিগ্রহণ করেছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খান বলেন, ‘ডিসিআর হচ্ছে স্বল্প মেয়াদি বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া। সেখানে শর্ত ভঙ্গ করলে ডিসিআর বাতিলের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। সহকারী কমিশনারকে নির্দেশ দেব কোনো শর্ত ভঙ্গ করে পাকা ভবন নির্মিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে।
(সরকারি জমিতে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের বহুতল ভবন দখলে নিয়েছে অন্য একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। এ নিয়ে বিস্তারিত থাকছে তৃতীয় পর্বে। (সূত্র: অনলাইন)