
নিজস্ব প্রতিবেদক : এক সময়ে স্টিমারের হুইসেলের শব্দ ও পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দে প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙতো বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী মানুষের। সদর ঘাট কিংবা পোস্তগোলা ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে থাকতো দর্শনার্থীরা। গত কয়েক বছর ধরে স্টিমারের সেই শব্দ পাচ্ছে না এই অঞ্চলের মানুষগুলো। নদী পথের ঐতিহ্যবাহি আর স্মৃতিঘেরা স্টিমার পিএস মাহসুদ্ আবার ফিরছে সগৌরবে। রকেট পিএস মাহসুদ এখন বুড়িগঙ্গার বাদামতলি ঘাটে, যাত্রার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। সু-খবর হচ্ছে আগামী ১৫ নভেম্বর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ নিয়ে সদর ঘাট থেকে বরিশালে ফিরছে ঐতিহ্যবাহি এ নৌযান।
এর আগে গত ২৪ অক্টোবর পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ রুটে একদিনের জন্য চলাচল করে। ওইদিন স্টীমারে উপস্থিত ছিলে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টান মেজর জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাদমতলী ঘাটে পিএস মাহসুদকে সাজিয়ে তোলার কাজ চলছে নিঃশব্দ তৎপরতায়। কোথাও কেউ রং তুলছে, কেউ ইঞ্জিন পরীক্ষা করছে, কেউ বা কেবিনের আনাচে-কানাচে খুঁত খুঁজছে বারবার। পুরনো এই স্টিমারের জরাজীর্ণ কলকব্জা সারিয়ে তোলার আন্তরিক চেষ্টায় ব্যস্ত সবাই। এই চেষ্টায় কত যত্ন মিশে আছে তা বোঝা যায় এটির ফিরে পাওয়া নবযৌবন দেখেই। বার্ধক্যেও সে যেন চিরযৌবনা। নবেম্বরে আবার নদীতে নামবে মাহসুদ। চার বছরের অবসরের পর এই ফিরে আসাকে ঘিরে কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার সীমা নেই। যেন প্রিয়জনের ফিরে পাওয়ার আনন্দে মুখর তারা।
জানা গেছে, এই প্যাডেল স্টিমার ঘিরে এখন সাজসাজ রব। নতুন রঙে-রূপে সেজে উঠছে অনেকটা বাজপাখি সদৃশ মাহসুদ। যদিও সবাই আজও চেনে একে জলের কমলা রকেট নামেই। নামের পেছনে আছে একসময়ের বিস্ময়কর গতি ঢাকা থেকে খুলনা পৌঁছাতে লাগত মাত্র ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা! সে সময়ের তুলনায় অবিশ্বাস্য দ্রুত। যাত্রীরা বিস্ময়ে বলতেন, এ যেন রকেটের মতো ছুটে চলে! সেই থেকেই নাম হয় জলের রকেট। আর কমলা রঙের গাত্রবর্ণে যুক্ত হয় ‘কমলা রকেট’ নাম।
নৌযান পিএস মাহসুদের ইঞ্জিন চালক সোহাগ জানান, সময় বদলেছে। পদ্মা সেতু হওয়ার পর সড়কপথের জনপ্রিয়তায় হারিয়ে গেছে সেই নদীপথের জৌলুস। আগে যেখানে ৫০০ যাত্রী যেত, সেতু হওয়ার পরে ২০০ জনও হয় না। তাই স্টিমার সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। অথচ একসময় নদীর বুক জুড়ে রাজত্ব করত এই রকেট মাহসুদ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ গন্তব্যে পৌঁছাতে ভরসা রাখতেন এর ওপর।
সোহাগ জানান, দক্ষিণবঙ্গের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান সবাই কোনো না কোনো সময় মাহসুদের যাত্রী ছিলেন। এমনকি একসময় এই স্টিমারে চড়েছেন ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথও।
বরিশালের মুলাদীর বাসিন্দা সাইফুল এর আগে তিন বছর ছিলেন ইঞ্জিন সহকারী। তার চোখে মাহসুদের বিশেষত্ব হলো এর প্যাডেল ব্যবস্থা।বাকি স্টিমার চলে পপুলার সিস্টেমে, কিন্তু মাহসুদ চলে প্যাডেল সিস্টেমে। যখন প্যাডেল পানিতে ঘোরে, দৃশ্যটা সত্যিই অসাধারণ লাগে। পুরো সিস্টেমটাই আলাদা।
তিনি বলেন, আগামী ১৫ নভেম্বর জমকালো আয়োজনে পুনরায় যাত্রা শুরু করবে শতবর্ষী এই রকেট স্টিমার। তবে এবার আর ঢাকা–খুলনা রুট নয়, বরং পর্যটকদের জন্য মনোরম ঢাকাÑবরিশাল নদীপথেই চলবে মাহসুদ। নির্ধারিত হয়েছে সপ্তাহে দুই দিন প্রতি শুক্রবার ঢাকা থেকে বরিশাল এবং শনিবার বরিশাল থেকে ঢাকা আসবে এ জলযান।
মাহসুদের কমার্শিয়াল ডিজিএম তানভীর আহমেদ বলেন, আগে খুলনা পর্যন্ত সার্ভিস দেওয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু এখন আর দেওয়া হবে না। রাতেও কোনো ট্রিপ থাকবে না। কেবল দিনের বেলায় চলবে মাহসুদÑঢাকা থেকে চাঁদপুর হয়ে বরিশাল, আবার বরিশাল থেকে ঢাকা।
তিনি জানান, এবার মাহসুদের সার্ভিস হবে রিভার ক্রুজের মতো। দীর্ঘ মেরামতের পর ৫০০-র বেশি যাত্রী ধারণক্ষমতা থাকলেও নিরাপত্তার স্বার্থে যাত্রী নেওয়া হবে সীমিত আকারে। যদিও স্টিমারটি পুরোনো, তবু ইঞ্জিন, জেনারেটর ও কেবিন সবকিছুতেই এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এখন চারটি জেনারেটর বসানো হয়েছে (আগে ছিল তিনটি), ইঞ্জিনে সংযোজন হয়েছে নতুন যন্ত্রাংশ, বদলে দেওয়া হয়েছে তলার প্লেটগুলো। বাড়ানো হয়েছে এসির ক্ষমতা। রাডার, ইকোসাউন্ড, জিপিএস ও কম্পাসসবই আপডেট করা হয়েছে আধুনিক সংস্করণে।
মাহসুদের কমার্শিয়াল ডিজিএম তানভীর আহমেদ জানান,খুব শিগগিরই নতুন ভাড়ার তালিকা প্রকাশ করা হবে।” আগের ভাড়া ছিল এসি কেবিন ২০০০ টাকা, নন-এসি ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা এবং ডেকের ভাড়া পড়তো প্রায় ১৪০ টাকা। এবার তাতে কিছুটা পরিবর্তন আসবে বলে ইঙ্গিত দিলেন তিনি। ঢাকা থেকে বরিশাল যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা, তবে অনুকূল আবহাওয়া ও জোয়ার থাকলে ৯ ঘণ্টা ৩০ মিনিটেই গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে।
আগামী ১৫ নভেম্বর বরিশালে ফিরছে পিএস মাহসুদ । বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামান। তিনি বলেন, ঢাকা- বরিশাল রুটে পিএস মাসুদ সপ্তাহে দুইদিন দিবা সার্ভিসে চলাচল করবে। সে জন্য চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন থেকে পিএস মাহসুদ ও পিএস অস্ট্রিচ মেরাতম করে পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হয়েছে। এর মধ্যে পিএস মাসুদের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার কাজও শেষ হয়েছে।
তিনি বলেন, আগামী ১৫ নভেম্বর জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে পিএস মাহসুদের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে চলাচলের ঘোষণা দেওয়া হয়। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ওই দিন সকালে বরিশালের উদ্দেশে পিএস মাহসুদ যাত্রা করবে। বরিশাল ঘাটে রাতে যাত্রা বিরতি দিয়ে পরের দিন ১৬ নভেম্বর সকালে পুনরায় ঢাকায় ফিরবে।
তিনি বলেন, শত বছরের প্যাডেল স্টিমারগুলো আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমার পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। তাই ঢাকা- বরিশাল রুটে পিএস মাহসুদ, সপ্তাহে দুই দিন এই রুটে চলাচলের জন্য দিবা সার্ভিসে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রতি শুক্রবার সকালে ঢাকা থেকে ছেড়ে বিকেলে বরিশালে পৌঁছাবে। আবার ফিরতি যাত্রায় ঢাকায় ফিরবে। এ ছাড়া ঢাকার আশপাশে প্রমোদভ্রমণের জন্য স্টিমারটি ভাড়া নেওয়া যাবে। প্রয়োজনে যে কেউ নির্ধারিত ভাড়ার পরিশোধ করে রিজার্ভ নিতে পারবেন।
এস এম আশিকুজ্জামান জানান, পুরোনো স্টিমারগুলোর ইঞ্জিনের শক্তি আগের মত নেই। স্টিমারে ঢাকা থেকে বরিশালের যেতে সময় সময়সাপেক্ষ বিষয়। এছাড়া নিয়মিত সার্ভিস নিয়ে এর ব্যয় বহনও সম্ভব নয়। তাই সব বিষয়গুলো বিবেচনা করে প্রমোদ তরী হিসেবে সপ্তাহে দুইদিন ঢাকা-বরিশাল রুটে স্টিমার চলাচল করবে।