
নিজস্ব প্রতিবেদক// ‘এই সাগরই আমাদের ভাত দেয়, বেঁচে থাকার জন্য অর্থ দেয়, সম্মান দেয়, আবার এই সাগরই আমাদের প্রাণ কেড়ে নেয়। আল্লাহর রহমতে জীবন নিয়ে ফিরে আসলেও ডুবে যায় হাজারো জেলের স্বপ্ন।’
কথাগুলো বলছিলেন ৫ দিন গভীর সমুদ্রে ভেসে থাকা জেলে বশির মাঝি। চোখের সামনেই লাখ লাখ টাকার ট্রলার ঢেউয়ের ঝাপটা তলিয়ে গেছে, রক্ষা করতে পারেননি আদরের সন্তানকে।
জানা যায়, পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও কুয়াকাটার প্রায় ৫ হাজার জেলে রয়েছে। এর মধ্যে কিছু জেলে রয়েছে, যারা ৩-৪ জন লোক নিয়ে ছোট নৌকা নিয়ে সাগরে যায়। তাদের ক্ষুদ্র জেলে বলে। আর মহিপুর-আলিপুর মৎস্য বন্দর থেকে লাখ লাখ টাকার ট্রলার সাগরে যায়।
কলাপাড়া উপজেলার আড়তগুলোতে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়। তবে যে জেলেরা নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য, দেশের অর্থনীতির জন্য মাছ শিকার করে, সেই জেলেদের জীবনের কোন মূল্যই নেই সরকারসহ আড়ত মালিক-মহাজনদের কাছে।
ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশ, উত্তাল সাগরের গর্জন, তীরের দিকে তাকিয়ে শত শত নারীর চোখে উৎকণ্ঠা—এই যেন উপকূল অঞ্চলের প্রতিদিনের দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ, লঘুচাপ ও হঠাৎ উত্তাল সমুদ্রে নিখোঁজ হয়েছেন অনেক জেলে, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন পটুয়াখালী, বরগুনা, ও পাথরঘাটা, মহিপুর, আলিপুর, কুয়াকাটার স্থানীয় ট্রলার মালিক ও মৎস্যজীবী।
কলাপাড়া উপজেলার ছোট্ট গ্রাম লালুয়া ইউনিয়ন, যেখান থেকে প্রতিবছর জেলেদের জীবন হারাতে হয়। কারণ এখানকার বেশি মানুষ গভীর সমুদ্রে মাছ ধরে। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস থাকলেও জীবিকার তাগিদে অনেকে ট্রলার নিয়ে গভীর সমুদ্রে চলে যান। কিন্তু ফিরে আসেননি অনেকেই।
উপকূলে ফিরে আসা কিছু ট্রলার জানিয়েছে, হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে ঝড় আঘাত হানে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় মাছধরা নৌকা ও ট্রলার।
আমরা উপকূলের হাজারো জেলে- যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন গভীর সমুদ্রে নামি, মাছ ধরে দেশের চাহিদা পূরণ করি, রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আনি। কিন্তু আজ আমরা কথার মুখোমুখি নই, বাস্তবতার মুখোমুখি। ঘূর্ণিঝড়, হঠাৎ ঢেউ, ট্রলার ডুবে যাওয়া- এসব আমাদের জীবনের প্রতিদিনের ঘটনা। কিন্তু যখন কেউ হারিয়ে যায়, কেউ মারা যায়- তখন সরকারি সহায়তার নামে শুধু চাল আসে। অথচ সেই পরিবারটির জীবন, শিশুর ভবিষ্যৎ আর বিধবা স্ত্রীর কান্না- সেগুলোর কোনো মূল্যায়ন হয় না।
সরকারের কাছে জেলেদের আবেদন, সহায়তার নামে চাল নয়, চাই স্বীকৃতি ও সম্মানজনক সহায়তা। গভীর সমুদ্রে নিখোঁজ বা নিহত জেলেদের জন্য স্থায়ী সরকারি ক্ষতিপূরণ। নৌ-দুর্ঘটনা বা ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়ে গেলে যেন সরকারি প্রক্রিয়ায় নিখোঁজ হিসেবে স্বীকৃতি মেলে এবং তার ওপর ভিত্তি করে সহায়তা দেওয়া হয়। মৎস্যজীবীদের জন্য জীবনবীমা চালু করতে হবে।