
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: নির্বাচনের দিন ভোট কেন্দ্র দখলের জন্য ভাড়াটিয়া বোমা তৈরির কারিগরদের নিয়ে নির্জন এলাকায় বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরনে দুইজন নিহত হয়েছে। অবশেষে বিষয়টিকে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড দাবি করে নিহত একজনের পরিবারের পক্ষে মোকাম বরিশাল বিজ্ঞ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলা দায়ের করা হয়েছে। আদালতের বিচারক মামলাটি এজাহারভূক্ত করার জন্য গৌরনদী মডেল থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলায় সাতজনের নামোল্লেখ করে আরো অজ্ঞাতনামা ৪/৫ জনকে আসামি করা হয়। মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) দুপুরে গৌরনদী মডেল থানার ওসি মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, আদালতের নির্দেশে থানায় মামলাটি এজাহারভূক্ত করার পর ইতোমধ্যে তদন্তের কাজ শুরু করা হয়েছে।
বোমা বিস্ফোরনের পর গুরুত্বর আহত হয়ে টানা নয়দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা মুলাদী উপজেলার বাটামারা ইউনিয়নের পূর্ব তয়কা গ্রামের কামাল বেপারীর স্বজন দুলাল বালী বাদী হয়ে দায়ের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন, মামলার প্রধান আসামি কৌশলে তার ফুফাতো ভাই কামাল বেপারীকে ঘটনাস্থলে এনে বোমা বিস্ফোরন ঘটিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তিনি আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তারপূর্বক সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেছেন। নিহত কামাল বেপারী পূর্ব তয়কা গ্রামের মৃত সেলিম বেপারীর ছেলে।
মামলার নামোল্লেখ করা আসামিরা হলো-মুলাদী উপজেলার চিঠিরচর গ্রামের মালেক শিকদারের ছেলে আব্বাস শিকদার, বিমানবন্দর থানার করমজা গ্রামের মৃত লতিফ হাওলাদারের ছেলে নুরুল ইসলাম, মুলাদীর সাহেবেরচর গ্রামের মৃত মালেক বেপারীর ছেলে আবু হানিফ, চিঠিরচর গ্রামের মৃত জোনাবালী শিকদারের ছেলে শাহিন শিকদার ও আনু শিকদার, খুনেরচর গ্রামের মৃত রশিদ বালীর ছেলে ওহিদুল বালী, তয়কা গ্রামের আমিন আকনের ছেলে লেলিন আকন।
এজাহার সূত্রে এবং মামলার বাদি দুলাল বালী জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, মামলার প্রধান আসামি আব্বাস শিকদারের বড় ভাই আলতাফ হোসেন ছিলেন বরিশাল-১ (গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর গানম্যান। ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য গৌরনদী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন হাসানাত আব্দুল্লাহর প্রধান সহযোগি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র (বর্তমানে জেলহাজতে থাকা) হারিছুর রহমান হারিছ।
সূত্রমতে, ভোটের মাঠে নিজের পরাজয় নিশ্চিত জেনে হারিছুর রহমান ভোটের দিন বোমা হামলা চালিয়ে প্রতিটি ভোট কেন্দ্র দখল করে ভোট ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী তৎকালীন সংসদ সদস্যর গানমান্য আলতাফ হোসেনের মধ্যস্থতায় হারিছুর রহমান বিপুল পরিমান বোমা তৈরির জন্য আব্বাস শিকদারের মাধ্যমে ভাড়াটিয়া বোমা তৈরির কারিগরদের সাথে চুক্তি করে গৌরনদীতে নিয়ে আসে। আর তাদের দেখাশুনার দায়িত্ব দেওয়া হয় গৌরনদীর বার্থী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. শিমুল সরদারকে।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, হারিছুর রহমানের নির্বাচনে লোক লাগবে জানিয়ে আব্বাস শিকদার তাদের গ্রামসহ অন্যান্য এলাকার লোকজনদের ও মামলার আসামিদের ওই বছরের ২৩ জুন গৌরনদীতে নিয়ে আসে। তারা ইউপি সদস্য শিমুল সরদারের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ওইদিন মধ্যরাতে ধানডোবা গ্রামের ওয়াদুদ সরদারের নির্জন (বিলের মধ্যে) পান বরজের মধ্যে গিয়ে প্রধান আসামির (আব্বাস) হুকুমে অন্যান্য আসামিরা একাধিক বোমার বিস্ফোরন ঘটায়। এতে ঘটনাস্থলেই একজন নিহত ও কামাল বেপারী আহত হন।
পরবর্তীতে মৃত্যু নিশ্চিতের জন্য আব্বাস শিকদারের নির্দেশে কামাল বেপারীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। এরপর আব্বাসসহ কয়েকজনে ঘটাস্থলেই নিহত অজ্ঞাত মৃতের লাশ নিয়ে গুমের উদ্দেশ্যে দ্রুত স্থান ত্যাগ করার পর গুরুত্বর আহত কামাল বেপারীকে এজাহারভূক্ত দুইজন আসামি অতিগোপনে অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এনে জখমের কারণ লুকিয়ে ভর্তি করে সটকে পরেন।
খবর পেয়ে কামাল বেপারীর স্বজনরা হাসপাতালে যাওয়ার পর তাদের কাছে কামাল বেপারী এসব তথ্য জানিয়েছেন বলেও এজাহারের উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে হাসপাতালে টানা নয়দিন চিকিৎসার পর ২০২৪ সালের ২ জুলাই কামাল বেপারী মৃত্যুবরণ করেন।
মামলার বাদী দুলাল বালী অভিযোগ করে বলেন, প্রধান আসামি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী হওয়ায় এতোদিন তারা মামলা দায়ের করতে সাহস পাননি। এরইমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা গৌরনদী মডেল থানায় মামলা দায়ের করতে গেলেও তাদের আদালতে মামলা দায়েরের পরামর্শ দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরনে ঘটনাস্থলেই নিহত ব্যক্তি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থানার শিতলতারা এলাকার কাঞ্চন মাঝির ছেলে জাহাঙ্গীর মাঝি। অভিযোগ রয়েছে, ঘটনার পর পরই পুরো বিষয়টি ধামাচাঁপা দেওয়ার জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হারিছুর রহমানের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে মোটা অংকের টাকা দেওয়া হয়েছিলো। যেকারণে ওইসময় চাঞ্চল্যকর এ বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গৌরনদী সার্কেল) শারমিন সুলতানা রাখি বলেন, আদালতের নির্দেশে গত ২১ জুলাই মামলাটি থানায় এজাহারভূক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ মামলার তদন্ত কাজ শুরু করা হয়েছে। তবে ঘটনাটি প্রায় ১৩ মাস পূর্বের হওয়ায় কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আশা করছি খুব শীঘ্রই মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে ভাল কিছু বের হবে।