ফরিদপুর-বরিশাল-কুয়াকাটা ৬ লেন: দাতার খোঁজে ৩৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প


Barisal Crime Trace -FF প্রকাশের সময় : আগস্ট ২৪, ২০২৩, ১২:২১ অপরাহ্ণ /
ফরিদপুর-বরিশাল-কুয়াকাটা ৬ লেন: দাতার খোঁজে ৩৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল : দাতা মিললেই শুরু হবে ফরিদপুর-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক ৬ লেনে উন্নীত করার কাজ। এমনটাই আভাস মিলেছে সড়ক ও সেতু বিভাগ থেকে। ইতোমধ্যে ২৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেস সড়ক নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয়ের প্রস্তাবনা জমা দেওয়া হয়েছে ঢাকায়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে জানিয়েছে সড়ক বিভাগ। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ব্যয় হবে আরও সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় জমি অধিগ্রহণ চলছে জানিয়ে সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, অধিগ্রহণসংক্রান্ত সংশোধিত একটি প্রস্তাবনা ৩০ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনের সভায় উঠবে। তবে সেটা কেবল পটুয়াখালী অংশের। বাকি ৩ জেলায় বেশ জোরেশোরে চলছে জমি অধিগ্রহণ। এ খাতে যথেষ্ট বরাদ্দও রয়েছে। এখন মূল প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য কোনো দেশ বা দাতা সংস্থা পাওয়া গেলেই শুরু হবে ৬ লেনের মহাসড়ক নির্মাণের কাজ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ২০১৬ সালে ফরিদপুর থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়ক ৬ লেনে উন্নীত করার প্রাথমিক কাজ শুরু করে সড়ক ও সেতু বিভাগ। প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত করার পর ২০১৮ সালে তা তোলা হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) বৈঠকে। ওই বছরের ১১ অক্টোবর একনেকে পাশ হওয়া এই প্রকল্পে সড়ক নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ বাবদ ১ হাজার ৮৬৭ কোটি ৮৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এরপর থমকে যায় সব। ঝুলে যায় জমি অধিগ্রহণের কাজ। যে পদ্মা সেতু সামনে রেখে এই সড়ক নির্মাণ পরিকল্পনা নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; সেই সেতুর উদ্বোধন হলেও পড়ে থাকে ভাঙ্গা-কুয়াকাটা সড়ক ৬ লেনে উন্নীত হওয়ার কাজ।

বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে সড়কে যানবাহনের চাপ বাড়বে বুঝতে পেরেই প্রথমে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা এবং পরে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়ক ৬ লেনে উন্নীত করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ভাঙ্গা পর্যন্ত ৬ লেন চালু হওয়ার সুফল আমরা সবাই পাচ্ছি। কিন্তু এরপর থেকেই পড়তে হচ্ছে কপাল ভাঙা যন্ত্রণায়। ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত যে সড়ক তার প্রস্থ স্থানভেদে ১৮ থেকে ২৪ ফিট পর্যন্ত। সরু এই সড়কে চলতে গিয়ে একদিকে যেমন পোহাতে হচ্ছে যানজটের যন্ত্রণা; তেমনি বেড়ে যাওয়া যানবাহনের চাপে অপ্রশস্ত সড়কে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।’

বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে সড়ক ও সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাসুদ খান বলেন, ‘সড়ক নির্মাণে ঠিক কতটুকু জমি অধিগ্রহণ করতে হবে তা চিহ্নিত করার দায়িত্ব পাওয়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ভুলে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়। জমি চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে যেমন তারা সর্বশেষ ম্যাপ কিংবা পর্চা ব্যবহার করেনি, তেমনি অধিগ্রহণ প্রস্তাবনার জমি চিহ্নিতকরণেও ছিল ত্রুটি। দুইশ কিলোমিটারের বেশি সড়ক ৬ লেন করার ক্ষেত্রে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মাত্র ৩০২ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেয়। বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় আমরা যখন নিজস্ব সার্ভেয়ার দিয়ে জরিপ করি তখন দেখা যায় জমি লাগবে ১ হাজার ৯১ একর। প্রথম জরিপে যেখানে পটুয়াখালীতে অধিগ্রহণ প্রস্তাবনার জমি দেখানো হয় ৯৫ একর সেখানে কেবল এই একটি জেলাতেই ২য় জরিপে জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯৫ একরে। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত অধিগ্রহণ ব্যয়ও ১৮৭০ কোটি থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৫শ কোটিতে। সংশোধিত এই ব্যয়ের একটি প্রস্তাব বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। আগামী ৩০ আগস্ট কমিশনের সভায় এটি অনুমোদন পাবে বলে আশা করছি।’

সড়ক ও সেতু বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, ‘জমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত জটিলতা মূলত পটুয়াখালী জেলায়। এছাড়া প্রকল্পভুক্ত অন্য ৪ জেলায় বর্তমানে চলছে অধিগ্রহণের কাজ। এই ৩ জেলায় জমির মালিকদের চেক বুঝিয়ে দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন। পর্যাপ্ত বরাদ্দও রয়েছে। অধিগ্রহণ সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে সড়ক নির্মাণ শুরু করা যায় সেই লক্ষ্যে পিডিপিপি (প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাবনা) দাখিল করা হয়েছে। এতে ফরিদপুর শহর থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ৬ লেন সড়ক নির্মাণের যাবতীয় খুঁটিনাটি উল্লেখের পাশাপাশি সম্ভাব্য ব্যয়ও উল্লেখ করেছে সড়ক ও সেতু বিভাগ। জমি অধিগ্রহণ ব্যয়ের বাইরে এই সড়ক নির্মাণে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে জানানো হয়েছে।’

দাখিল করা পিডিপিপি সূত্রে জানা যায়, ফরিদপুরে ৩২ দশমিক ৫ কিমি., বরিশালে ৭৬ দশমিক ৮০ কিমি., মাদারীপুরে ৪৫ কিমি. এবং পটুয়াখালীতে ৮২ দশমিক ৪ কিমি.জুড়ে থাকবে ৬ লেনের বিস্তার। সড়কে ঝালকাঠি, বরগুনা এবং গোপালগঞ্জ সড়ক বিভাগের কিছু অংশ থাকলেও কাজের সুবিধার্থে তা ফরিদপুর, বরিশাল এবং পটুয়াখালী সড়ক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের প্রস্থ হবে কমবেশি ১৮০ ফুট। কেন্দ্র থেকে উভয় প্রান্তে থাকবে ৯০ ফুটের বিস্তৃতি। গড়ে ১২০ থেকে ১৩০ ফুটের উচ্চতার সঙ্গে দুপাশে ঢাল হবে ১৪৫ থেকে ১৫০ ফুট। পিডিপিপি দাখিল হলেও কবে নাগাদ শুরু হতে পারে এই সড়ক নির্মাণ সেই খোঁজ নিতে গিয়েই মেলে জটিলতা। বিপুল অর্থ ব্যয়ের এই প্রকল্পের অর্থের জোগান নিয়ে খোদ সড়ক ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারাই আছেন দুশ্চিন্তায়।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে সড়ক বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘২০১৮ সালে যখন প্রথম এই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ প্রস্তাবনা একনেকে পাশ হয় তখন অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়েছিল এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। পরে দীর্ঘসূত্রতার কারণে তারা আর আগ্রহ দেখায়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চাইলে নিজস্ব অর্থায়নেই এই কাজ শুরু করা সম্ভব। আর যদি দাতা সংস্থার ওপর নির্ভর করতে হয় তবে হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে।’

বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে সড়ক ও সেতু বিভাগ বরিশালের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও ফরিদপুর-কুয়াকাটা ৬ লেন সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক একেএম আজাদ রহমান বলেন, ‘বর্তমানে পুরোদমেই চলছে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। জমি অধিগ্রহণ প্রায় শেষ করে এনেছি আমরা। দাখিল করা পিডিপিপি অনুমোদন পেলে হাত দেওয়া হবে সড়ক নির্মাণকাজে। এখানে ফান্ডিংয়ের কোনো সমস্যা নেই। সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের আওতায় যত দ্রুত সম্ভব এই ৬ লেন সড়ক নির্মাণ সম্পন্ন করতে চাই আমরা। এখন কেবল পিডিপিপি অনুমোদন এবং পরবর্তী কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষা।’ যুগান্তর